ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপের টাকা বের করে নেওয়া, জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের নিত্যনতুন কৌশলের তথ্য বেরিয়ে আসছে। এবার জানা গেল চেক বা পে-অর্ডার নয়; বরং ‘সাদা কাগজে হাতে লেখা স্লিপ’ দিয়ে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার তথ্য। গত জানুয়ারি মাসে ইসলামী ব্যাংকের হেড অফিস করপোরেট শাখায় ৪৮ কোটি টাকা দেওয়ার জন্য হাতে লেখা একটি স্লিপ দেওয়া হয়। ওই স্লিপে এস আলমের নির্দেশে অ্যানন টেক্স নামে একটি প্রতিষ্ঠানকে ৪৮ কোটি টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেন ব্যাংকের তৎকালীন ডিএমডি (উপ-মহাব্যবস্থাপক) আকিজ উদ্দিন। ব্যাংকের একজন এসপিও (সিনিয়র প্রিন্সিপাল অফিসার) ব্যাংকিং নীতিবিরোধী এই কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদ করে টাকা দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরে ওই কর্মকর্তাকে ঢাকা থেকে নীলফামারী বদলি করা হয়। বর্তমানে তিনি ঢাকার একটি করপোরেট অফিসে কর্মরত।
ব্যাংকের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা কালবেলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করে বলেন, ২০২৩ সালের শেষদিকে ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম গ্রুপ টাকা বের করে নেওয়ার এই অভিনব পদ্ধতি চালু করে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামের বড় বড় শাখায় হাতে লেখা স্লিপ দিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা তুলে নিত তারা। কোনোরকম বিনিয়োগ ছাড়করণ ব্যতিরেকে শুধু স্লিপের ওপর ভিত্তি করে ক্যাশ টাকা দিতে হতো এস আলম গ্রুপকে। এসব স্লিপ ব্যাংকে পাঠাতেন তৎকালীন ডিএমডি আকিজ উদ্দিন, মিফতাহ উদ্দিন ও রেজাউল করিম। এর বাইরেও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের সচিবালয় থেকে বিভিন্ন শাখায় ফোন করে নির্দিষ্ট পরিমাণ ক্যাশ টাকা নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা স্থানে দিয়ে আসতে বলা হতো। শাখাগুলো সাসপেন্স অ্যাকাউন্ট ডেবিট করে এই টাকা বের করে দিত, যার মাশুল এখনো গুনতে হচ্ছে ব্যাংকটিকে।
ইসলামী ব্যাংকে এস আলম গ্রুপ ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে দেওয়া ঋণের ওপর বাংলাদেশ ব্যাংক ও ইসলামী ব্যাংকের নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় বেশ কয়েকটি নিরীক্ষা পরিচালনা করা হয়। ওইসব নিরীক্ষায় দেখা যায়, এস আলমের সরাসরি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানগুলো ইসলামী ব্যাংকের চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে ঋণ নিয়েছিল। তাই নিরীক্ষা বিভাগ খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে নিরীক্ষা শুরু করে। ওই একটি শাখা থেকেই ৬৮ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেওয়ার তথ্য মেলে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ব্যাংকটির খাতুনগঞ্জ শাখার ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ জামাল উদ্দিন কালবেলাকে বলেন, ‘কয়েকটি নিরীক্ষা হয়েছে। সেখানে এস আলম গ্রুপ ছাড়াও অন্য একাধিক প্রতিষ্ঠানের ঋণের তথ্যও চলে এসেছে। যাদের সঙ্গে এস আলম গ্রুপের সম্পৃক্ততা নেই।’ এস আলম গ্রুপের ঋণের পরিমাণ ৬৮ হাজার কোটি টাকা কি না? এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘না, এর পরিমাণ এত হবে না।’
ইসলামী ব্যাংকের দায়িত্বশীল একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, ‘যে কোনো ব্যাংক তার কোনো গ্রাহককে ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে চারটি স্তর থাকে। সার্বিক ঋণ কার্যক্রমে কোনো ঝুঁকি আছে কি না, তা পর্যালোচনা করে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়; কিন্তু এস আলম ও তাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিয়মনীতি অনুসরণ করা হয়নি।
মুরাবাহা (পণ্যের ক্রয়মূল্য-বিক্রয়মূল্য এবং বিক্রয় থেকে লব্ধ লাভ) টিআর পদ্ধতিতে ইসলামী ব্যাংক থেকে এস আলম ও তার সহযোগী বিভিন্ন গ্রুপ টাকা তুলে নেওয়ার বিষয়ে ব্যাংকটির একাধিক কর্মকর্তা কালবেলাকে বলেন, এস আলম গ্রুপের নামে-বেনামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, তাদের সহযোগী নাবিল গ্রুপের কয়েকটি বেনামি কোম্পানির নামে ঋণ নেওয়া হয়। ‘মুরাবাহা টিআর’ পদ্ধতিতে এক বছরের গ্রেস পিরিয়ড ভিত্তিতে নাবিল গ্রুপ কয়েক হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়। মুরাবাহা টিআর পদ্ধতিতে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং ইসলামী ব্যাংকের নিজস্ব ঋণ বিতরণ নীতিমালা অনুযায়ী প্রয়োজনীয় জামানত, কাগজপত্র ও পণ্য ক্রয়ের নথিপত্র ছাড়াই ভুয়া নামসর্বস্ব কোম্পানির নামে এসব ঋণ দেওয়া হয়।
ইসলামী ব্যাংকের করপোরেট ইনভেস্টমেন্ট ডিভিশনের এক কর্মকর্তা জানান, এই ডিভিশনপ্রধান ডিএমডি মিফতাহ উদ্দিনের নির্দেশনা অনুযায়ী তৎকালীন ডিএমডি এবং বর্তমান এমডি মুনিরুল মওলার তত্ত্বাবধানে নামসর্বস্ব কোম্পানির নামে হাজার হাজার কোটি টাকার ঋণ নেওয়ার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। ব্যাংকের রাজশাহী শাখা, নিউ মার্কেট শাখা রাজশাহী, রাজধানীর ফার্মগেট শাখা, নবাবপুর রোড শাখা, ভিআইপি রোড শাখা ও গুলশান সার্কেল-২ শাখা থেকে ১১ টিরও বেশি ভুয়া কোম্পানির নামে ১২ হাজার কোটি টাকারও বেশি তুলে নেওয়া হয়। ওই সময়কার ডিএমডি মিফতাহ উদ্দিন প্রজেক্ট প্রোফাইল তৈরি করে সংশ্লিষ্ট শাখায় পাঠাতেন এবং শাখা ব্যবস্থাপকদের নির্দেশ দিতেন প্রধান কার্যালয়ে ঋণ আবেদন পাঠানোর জন্য। বড় অঙ্ক হওয়ায় এসব ঋণ প্রস্তাবনা করপোরেট ইনভেস্টমেন্ট ডিভিশন-১-এর প্রধান মিফতাহ উদ্দিনের কাছে যেত এবং তিনিই অনুমোদনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতেন।
১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি অনুসন্ধানে দুদক ইসলামী ব্যাংকে এস আলমের ঋণ জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাৎ নিয়ে বেশ কিছু অভিযোগ জমা হয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। কমিশন থেকে এসব বিষয়ে একাধিক টিম কাজ করছে। চট্টগ্রামের চাক্তাইসহ কয়েকটি শাখা থেকে এস আলম গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকতায় নাবিল গ্রুপসহ চার প্রতিষ্ঠানকে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতির অভিযোগ পেয়ে অনুসন্ধানে নেমেছে দুদক। কমিশনের উপপরিচালক ইয়াসির আরাফাত অভিযোগটির অনুসন্ধানে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি গত ৮ সেপ্টেম্বর নাবিল গ্রুপের ১১ প্রতিষ্ঠান, ইসলামী ব্যাংক ও বাংলাদেশ ব্যাংকে এসব ঋণ জালিয়াতির তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছেন। ওই চিঠিতে ‘রাজশাহীভিত্তিক নাবিল গ্রুপের ঠিকানা ব্যবহার করে ১১টি প্রতিষ্ঠানের নামে সৃষ্ট ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণের বিস্তারিত তথ্য চেয়েছেন তিনি। নাবিল গ্রুপের নামে বিতরণ করা ঋণের প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা ব্যাংকটির মালিকানার সঙ্গে যুক্ত এস আলম গ্রুপ ‘বিশেষ সুবিধা’ হিসেবে তুলে নিয়ে বিদেশে পাচার করেছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে দুদকে পাঠানো নথিতে উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া চট্টগ্রামভিত্তিক ৩ প্রতিষ্ঠানের কাছে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকার ঋণ জালিয়াতির তথ্য চাওয়া হয় দুদকের চিঠিতে।
এতে বলা হয়, চট্টগ্রামের আসাদগঞ্জের ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্সের মালিক মো. গোলাম কিবরিয়া চৌধুরীসহ অন্যদের বিরুদ্ধে ঋণের নামে ইসলামী ব্যাংকের টাকা আত্মসাতের অভিযোগ সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে বর্ণিত ঋণগুলো সম্পর্কে রেকর্ডপত্র ও তথ্যাদি পর্যালোচনা করা প্রয়োজন।
দুদকের উপপরিচালক ইয়াসির আরাফাত কালবেলাকে বলেন, ‘চিঠিতে ইসলামী ব্যাংক চট্টগ্রামের চাক্তাই শাখার গ্রাহক মেসার্স মুরাদ এন্টারপ্রাইজ ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান, ইসলামী ব্যাংকের জুবিলী রোড শাখার গ্রাহক ইউনাইটেড সুপার ট্রেডার্স ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান, ইসলামী ব্যাংক খাতুনগঞ্জ করপোরেট শাখার গ্রাহক সেঞ্চুরি ফুড প্রোডাক্টস ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের তথ্য চাওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নাবিল গ্রুপের ১১ প্রতিষ্ঠানের তথ্য চাওয়া হয়েছে; কিন্তু গত রোববার পর্যন্ত তারা কোন তথ্য দেয়নি। এ বিষয়ে ইয়াসির আরাফাত বলেন, প্রতিষ্ঠানগুলো তথ্য দিতে এবং নথিপত্র সংগ্রহ করতে আরও কিছু দিন সময় চেয়েছে।
দুদকে প্রাপ্ত অভিযোগের বরাত দিয়ে কর্মকর্তারা জানান, ইসলামী ব্যাংক, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক ও সোস্যাল ইসলামী ব্যাংকে নাবিল গ্রুপের ঋণের পরিমাণ ৬ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। এর মধ্যে ইসলামী ব্যাংকের রাজশাহী শাখা ২০২২ সালের ২১ মার্চ নাবিল ফিড মিলস ও সহযোগী প্রতিষ্ঠানের নামে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকা ঋণ অনুমোদন দেয়। ব্যাংকটির গুলশান শাখায় নাবিল গ্রেইন ক্রপসের নামে অনুমোদন দেওয়া হয় ৯৫০ কোটি টাকা ঋণ। নাবিল গ্রুপকে দুটি শাখা থেকে ঋণ দেওয়া হয় ৪ হাজার ৫০ কোটি টাকা। একই বছরের ২৩ জুন ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংকের ২৪৬তম বোর্ড সভায় নাবিল নব ফুড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান, নাবিল ফিড মিলস এবং শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে ১ হাজার ২০০ কোটি টাকা ঋণ দেওয়া হয়। একই বছরের ৩০ মে সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের ৪৮১তম বোর্ড সভায় গুলশান শাখা থেকে নাবিল নব ফুড ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান, নাবিল ফিড মিলস এবং শিমুল এন্টারপ্রাইজের নামে ১ হাজার ১২০ কোটি টাকার ঋণ অনুমোদন দেওয়া হয়। এর মধ্যে ফান্ডেড (নগদ) ৪৫০ কোটি এবং নন-ফান্ডেড (এলসি ও ব্যাংক গ্যারান্টি) ৬৭০ কোটি টাকা। এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগসীমা নতুনভাবে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে, কিন্তু কোন খাতে এই টাকা ব্যবহার হবে, তা উল্লেখ করা হয়নি। এভাবে তারা প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকা ঋণ জালিয়াতি করেছে।
সিএসআর ও ব্যাংক ফাউন্ডেশন থেকে টাকা উত্তোলন দেশের অন্যতম বৃহৎ ব্যাংক হিসেবে ইসলামী ব্যাংকের করপোরেট সোশ্যাল রেসপনসিবিলিটি (সিএসআর) ফান্ডে অর্থের পরিমাণ অনেক। এস আলম গ্রুপ এই ফান্ড থেকে কোটি কোটি টাকা তুলে নিয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। সিএসআর বিভাগটি ‘অবাণিজ্যিক’ হলেও এটিকে করপোরেট ইনভেস্টমেন্টের অধীনে রাখা হয়। যার দায়িত্বে ছিলেন ডিএমডি মিফতাহ উদ্দিন। ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন (আইবিএফ) ব্যাংকের একটি অন্যতম বৃহৎ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা। ইসলামী ব্যাংকের অনুদান ছাড়াও এখানে ধর্মপ্রাণ মানুষের যাকাতের অর্থ ও বিপুল পরিমাণ বিদেশি অনুদান আসে। আইবিএফের আওতায় রাজধানীসহ সারা দেশে ২৩টি জেনারেল ও স্পেশালাইজড হাসপাতাল রয়েছে। এর বাইরে ডায়াগনস্টিক সেন্টার, মেডিকেল কলেজ, নার্সিং ইনস্টিটিউট, টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসাসহ শতাধিক প্রতিষ্ঠান আছে। এই ফাউন্ডেশন থেকে নানা কৌশলে অর্থ তুলে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। মাসুদুল আলমের আপন ভাগ্নে ডাক্তার ডা. তানভীর আহমেদ ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন নিয়ন্ত্রণ করতেন। তিনি আবার ইসলামী ব্যাংকেরও ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন। এ ছাড়াও ফাউন্ডেশনে দীর্ঘসময় ধরে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন সাবেক চেয়ারম্যান প্রফেসর নাজমুল হাসান, বর্তমান এমডি মোহাম্মদ মনিরুল মওলা ও সাবেক ডিএমডি মোহাম্মদ আলী। ২০২০ সাল থেকে আইবিএফের বিভিন্ন হাসপাতালের জন্য ৯৯০ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি ও চিকিৎসাসামগ্রী ক্রয় করে। এস আলমের মালিকানাধীন অনভিজ্ঞ দুটি প্রতিষ্ঠান গ্লোবাল মেডিটেক ও ইউনিভারসেল হেলথ কেয়ারের মাধ্যমে এসব যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এর মধ্যে শুধু একটি টেন্ডারে সিটি স্ক্যান ৫টি, ক্যাথ ল্যাব ২টি, আলট্রা সাউন্ড ৭টি, আইসিউউ বেড ১৮৭টিসহ বিভিন্ন যন্ত্রপাতি কেনা হয়। এসব কেনাকাটায় বড় অঙ্কের অর্থ লুট করে নিয়েছে এস আলম গ্রুপ। এ ছাড়া হাসপাতালের অন্যান্য যন্ত্রপাতি, পরীক্ষা-নিরীক্ষার সরঞ্জাম (রি-এজেন্ট) ক্রয়েও বড় দুর্নীতি করেছে এস আলম গ্রুপ। সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ, এস আলম গ্রুপ ২০২০ সাল থেকে আইবিএফের বিভিন্ন ফান্ড থেকে কমপক্ষে ৫০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে।
রক্ষা পায়নি অফিসার্স ও কর্মচারী কল্যাণ সমিতির অর্থও ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দুটি পৃথক সমিতি রয়েছে। যা সমবায় অধিদপ্তরে নিবন্ধিত। ব্যাংকটির ২৪ হাজারের ওপরে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সমিতিতে সঞ্চয়ের বড় তহবিল ছিল। এস আলম তাদের মালিকানাধীন ইউনিয়ন ব্যাংককে ব্যবহার করে এই সমিতি থেকে ২০০ কোটি টাকারও বেশি তুলে নিয়েছে। যদিও সমবায় সমিতি থেকে টাকা তুলে নেওয়ার সুযোগ নেই। দীর্ঘ সময় ধরে সমিতি দুটির অপারেশনাল দায়িত্বে ছিলেন জালাল উদ্দিন ও মোস্তাক আহমদ।
কর্মচারী কল্যাণ সমিতির অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে সাধারণ সম্পাদক মোস্তাক আহমেদ কালবেলাকে বলেন, আমাদের জমানো অর্থের পরিমাণ ২০০ কোটি টাকার মতো। আমরা ব্যাংকে সেই অর্থ রেখে আবার কর্মচারীদের মধ্যে বিনিয়োগ করি। আমাদের এখান থেকে বড় অঙ্কের অর্থ আত্মসাতের ঘটনা ঘটেনি।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের লোক নিয়োগ অনুসন্ধানে জানা যায়, ইসলামী ব্যাংকে ২০১৭ সালের পর বিভিন্ন পদে ১০ হাজারেরও বেশি চট্টগ্রাম অঞ্চলের বিশেষ করে পটিয়া, সাতকানিয়া ও লোহাগড়া উপজেলার লোক নিয়োগ করা হয়। ডিএমডি আকিজ উদ্দিন ফার্স্ট সিকিউরিটি ব্যাংকে থাকাকালেও ইসলামী ব্যাংকসহ এস আলম গ্রুপের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জনবল নিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করতেন। ইসলামী ব্যাংক খাতুনগঞ্জ শাখা থেকে প্রধান কার্যালয়ের মানব সম্পদ বিভাগে নিয়োগ প্রার্থীদের বায়োডাটাসহ তালিকা পাঠানো হতো। ওই শাখায় কর্মরত মিফতাহ উদ্দিন এবং তার সহযোগী তাহেরুল আমিন তালিকা তৈরি করতেন। মানবসম্পদ বিভাগ প্রার্থীদের শিক্ষা সনদ ও অন্যান্য কাগজপত্র যাচাই এবং প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষা ছাড়াই ওই এলাকার লোকজন নিয়োগ দিতেন, যাদের বেশিরভাগই ব্যাংকে চাকরি করার মতো ন্যূনতম যোগ্যতাও ছিল না। সংশ্লিষ্টদের দাবি, নিয়োগপ্রাপ্ত ১০ হাজার ব্যক্তির অনেকেরই শিক্ষাগত যোগ্যতার সনদ ছিল ভুয়া। অনেকে চট্টগ্রামের একটি অখ্যাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সনদ কিনে ব্যাংকে জমা দিয়েছেন। ওই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নেওয়া অনেক সনদ জমা পড়েছিল নিয়োগপ্রত্যাশীদের, যা এখন তদন্ত করা হচ্ছে। আবার অনেকে প্রবাসী ভাই-বোনদের সনদ দিয়ে চাকরি নিয়েছেন। বাসা-বাড়িতে আয়া-বুয়ার কাজ করতেন বা বাজারে সবজি বিক্রি করতেন এমন ব্যক্তি বা তাদের ছেলে-মেয়েরাও ইসলামী ব্যাংকে কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। চাঞ্চল্যকর এই নিয়োগ বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করতেন ব্যাংকের কর্মকর্তা আকিজ উদ্দিন, মিফতাহ উদ্দিন ও তাহেরুল আমীন। ২০১৭ সাল থেকে এসব নিয়োগ অনিয়মে তাদের সহযোগী ছিল প্রধান কার্যালয়ের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান মাহবুব আলম, জাফর আলম, সালেহ ইকবাল, মোস্তাফিজুর রহমান সিদ্দিকী ও আকিজ উদ্দিন।
এস আলমের কথা না শুনলে নির্যাতন যথাযথ কর্তৃপক্ষ জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে অনুমোদন করলে সংশ্লিষ্ট সব অপারেশনাল ইউনিট ঋণ বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে বাধ্য হতো। কোনো কর্মকর্তা প্রতিবাদ করলে বা কাউকে সন্দেহভাজন মনে করলে তাদের নানা ধরনের নির্যাতনের শিকার হতে হতো। দুর্গম এলাকায় পদায়ন, গোয়েন্দা সংস্থা ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দিয়ে নির্যাতনও করা হতো। রাজধানীর মিন্টো রোডে ডিবি কার্যালয়ে নিয়েও অনেক কর্মকর্তাকে নির্যাতন করা হয়।
ব্যাংকারদের অভিযোগ, এস আলমের কোনো ব্যবসায়িক প্রস্তাবনা বাংলাদেশ ব্যাংকে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাস হয়ে যেত। ২০১৭ সাল থেকে গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, কয়েকজন ডেপুটি গভর্নর এবং ডেস্ক অফিসার এস আলমের পক্ষে কাজ করতেন।
এস আলমের জালিয়াতির অনুসন্ধানের বিষয় জানতে চাইলে দুদকের কমিশনার মো. জহুরুল হক কালবেলাকে বলেন, এস আলম গ্রুপ ও ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন দুর্নীতি অনিয়ম নিয়ে আমাদের একাধিক টিম কাজ করছে। কিছু ক্ষেত্রে তারা তথ্য দিতে সময় চেয়েছে। আমরা দ্রুততার সঙ্গে অনুসন্ধান ও তদন্ত সম্পন্ন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে চাই।
ইসলামী ব্যাংকে এস আলম গ্রুপের নজিরবিহীন জালিয়াতির বিষয়ে ব্যাংকটির বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক মনিরুল মাওলার কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।