• বুধবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৫, ০৬:৩১ অপরাহ্ন

লাশের লম্বা মিছিলেও ‘টনক নড়ছে না’ প্রশাসনের

আবিদুর রহমান সুমন / ৩৯ Time View
Update : শুক্রবার, ১১ এপ্রিল, ২০২৫

দুর্ঘটনার রাজপথে ফরিদপুর-মাগুরা ও ভাঙ্গা-বরিশাল মহাসড়ক: ১৬ মাসে প্রাণ গেল ১৬৬ জনের

পদ্মা সেতু চালুর পর দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা যতটা সহজ হয়েছে, ততটাই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে ফরিদপুর-মাগুরা হাইওয়ে, ঢাকা-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে, ফরিদপুর-ভাঙ্গা-বরিশাল এবং ভাঙ্গা-খুলনা মহাসড়কগুলো। প্রতিদিন হাজারো যানবাহন চলাচল করা এই সড়কগুলো যেন পরিণত হয়েছে মৃত্যুফাঁদে।

ফরিদপুর হাইওয়ে পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালের শুরু থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত ১৬ মাসে এসব রুটে মোট ১৪৭টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ হারিয়েছেন ১৬৬ জন, আহত হয়েছেন আরও ২৬৮ জন।

অব্যবস্থাপনা ও বেপরোয়া যান চলাচলই মূল কারণ

দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসেবে উঠে এসেছে—বেপরোয়া গতি, চালকদের ঘুম ঘুম ভাব, সড়কের নির্ধারিত লেন অমান্য করে চালানো, মহাসড়কে অবৈধ অটোরিকশার চলাচল এবং পুলিশের সীমিত তদারকি। এসব কারণে প্রায় প্রতিদিনই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা।

ফরিদপুরে গেল দুই বছরে ঈদের আগে-পরে বড় তিনটি দুর্ঘটনায় প্রাণ হারিয়েছেন ৩১ জন। প্রতিটি ঘটনার পর জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও অধিকাংশ সুপারিশ বাস্তবায়নের উদ্যোগ দেখা যায়নি।

সাম্প্রতিক দুর্ঘটনা ও তদন্ত

সর্বশেষ ৮ এপ্রিল ফরিদপুর সদর উপজেলার গেরদা ইউনিয়নের বাখুন্ডা এলাকায় বাস দুর্ঘটনায় সাতজন নিহত হন। এ ঘটনায় অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিন্টু বিশ্বাসের নেতৃত্বে সাত সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটিকে তিন কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।

তবে তদন্তের পর প্রশাসনের পক্ষ থেকে দু-একদিন তদারকি চালানো হলেও তা ধারাবাহিক নয়। যানবাহনের গতি নিয়ন্ত্রণে কোনো যন্ত্র বসানোরও উদ্যোগ নেই বলে জানিয়েছেন ফরিদপুর বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মো. নাসির উদ্দীন।

রেলক্রসিংও বিপজ্জনক

ফরিদপুর জেলার ৯০ কিলোমিটার রেলপথজুড়ে রয়েছে ২৭টি রেলক্রসিং, যার মধ্যে মাত্র পাঁচটিতে গেটম্যান রয়েছে। বাকি ২২টি সম্পূর্ণ অরক্ষিত। ফলে সড়কের পাশাপাশি রেলপথেও ঘটছে প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা।

২০২৪ সালের ১৬ এপ্রিল কানাইপুরে বাস-পিকআপ সংঘর্ষে ১৪ জন নিহত হন। ২০২৩ সালের ২৪ জুন ভাঙ্গার মালিগ্রামে অ্যাম্বুলেন্স দুর্ঘটনায় মারা যান অন্তত আটজন। উভয় ঘটনার পর তদন্ত কমিটি গঠিত হলেও সুপারিশ বাস্তবায়নে অগ্রগতি নেই।

বারবার সুপারিশ, বাস্তবায়নে গড়িমসি

একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনে সুপারিশ করা হয়েছে—এক্সপ্রেসওয়েতে কন্ট্রোল ক্যামেরা স্থাপন, ফিটনেসবিহীন গাড়ি বন্ধে তদারকি, হাইওয়ে পুলিশের নজরদারি বৃদ্ধি, লাইসেন্সবিহীন চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা এবং যানবাহনে গতি নিয়ন্ত্রক যন্ত্র বসানো। কিন্তু এসব সুপারিশ এখনও কাগজেই সীমাবদ্ধ।

প্রশাসন ও পুলিশের অসহায় স্বীকারোক্তি

হাইওয়ে পুলিশের মাদারীপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার শাহীনূর আলম বলেন, জনবল ও যানবাহনের চরম সংকটের কারণে নিয়মিত তদারকি সম্ভব হচ্ছে না। তাঁর ভাষায়, “ঢাল নেই, তলোয়ার নেই—নিধিরাম সরদার” অবস্থা আমাদের।

জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান মোল্লা জানান, সাম্প্রতিক দুর্ঘটনার তদন্ত চলছে। দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ ও দায়ীদের চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে। বাস মালিক ও শ্রমিকদের নিয়ে সভা করে সচেতনতামূলক উদ্যোগ নেওয়ার কথাও বলেন তিনি।

সমাধানে সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি

ফরিদপুরের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোদাররেস আলী ইসা বলেন, চালকদের অতিরিক্ত ক্লান্তি, ওভারটেকের ভুল কৌশল এবং ধীরগতির যানবাহনই দুর্ঘটনার মূল কারণ। শুধু আইন প্রয়োগ নয়, চালকদের সচেতন করাও জরুরি।

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, সুপারিশ বাস্তবায়ন ও নিয়মিত মনিটরিং না করলে পরিস্থিতির উন্নয়ন সম্ভব নয়। এ অবস্থায় দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে দুর্ঘটনার এই মরণফাঁদ আরও ভয়াবহ রূপ নিতে পারে।


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category